মঙ্গলবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৫, ০৬:২৭ অপরাহ্ন

ব্রিকসের বহুপাক্ষিক আর্থিক কাঠামো ও বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনা

  • হোসাইন মোহাম্মদ সাগর

বিশ্বের অর্থনৈতিক মানচিত্রে নাটকীয় পরিবর্তনের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পশ্চিমা বিশ্বের নেতৃত্বাধীন আর্থিক ব্যবস্থার পাশাপাশি উঠে আসছে একটি নতুন বলয়- ব্রিকস। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত এই গোষ্ঠী শুরুতে একটি রাজনৈতিক কল্পনা মনে হলেও আজ তা বাস্তবতা, এবং ক্রমশ এক শক্তিশালী আর্থিক ও কৌশলগত জোটে পরিণত হচ্ছে। নতুন নতুন সদস্য যুক্ত হওয়ায় এই বলয়ের প্রভাব আরও বিস্তৃত হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যেমন নতুন সুযোগের মুখোমুখি, তেমনি কূটনৈতিকভাবে চতুর ও কৌশলী ভূমিকা পালন করার সময় এখনই।

শেষ কয়েক বছরে বিশ্বব্যাপী ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েন, মহামারি, যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার ছায়ায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনেকটা এলোমেলো হয়ে পড়েছে। পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক কাঠামো, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংকের ওপর নির্ভরশীলতা অনেক দেশকেই একধরনের শর্তাধীন আর্থিক দাসত্বের মুখে ফেলেছে। ডলারনির্ভর বাণিজ্যিক লেনদেন আর মার্কিন নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া যেন সম্ভব হয়ে উঠছিল না। এই পরিস্থিতিতে ব্রিকস একটি বিকল্প আর্থিক কাঠামো তৈরি করতে উদ্যোগী হয়েছে, যেখানে সদস্য দেশগুলো নিজেদের প্রয়োজন ও বাস্তবতা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

এই বিকল্প কাঠামোর মূল ভিত্তি হলো নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা এনডিবি। এই ব্যাংক গঠিত হয়েছে সদস্য দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন এবং পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি শুধু ব্রিকস সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বাংলাদেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, আলজেরিয়া, কলম্বিয়া, উজবেকিস্তানসহ একাধিক দেশ ইতিমধ্যে এনডিবির সদস্য হয়েছে অথবা সদস্যপদ গ্রহণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এই ব্যাংকের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো- এর ঋণ ও সহযোগিতা আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের মতো কঠোর রাজনৈতিক শর্তে আবদ্ধ নয়। বরং এটি উদীয়মান অর্থনীতির বাস্তবতা, প্রয়োজন ও উন্নয়ন অভিমুখ বিবেচনায় নিয়ে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।

বাংলাদেশ ইতোমধ্যে এই ব্যাংকের সদস্য হয়েছে এবং দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও সামাজিক খাতে অর্থায়নের জন্য প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার তহবিল পাওয়ার পথে রয়েছে। ইতোমধ্যে ঢাকার পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্পে এনডিবি প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। শুধু সরকারি খাত নয়, হাসপাতাল, আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সামাজিক অবকাঠামোতে বেসরকারি অংশীদারিত্বে অর্থায়নের বিষয়েও আলোচনা চলছে। এটি বাংলাদেশের জন্য বড় অগ্রগতি, বিশেষ করে যখন বিশ্ববাজারে ডলার সংকট, রিজার্ভের চাপে মূল্যস্ফীতি ও টাকার অবমূল্যায়ন আমাদের অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

ব্রিকসের সম্প্রসারণ এবং এর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও বাংলাদেশকে নতুন কূটনৈতিক ব্যাকরণ শিখতে বাধ্য করছে। রিও ডি জেনেইরোতে সদ্য অনুষ্ঠিতব্য ব্রিকস সম্মেলনে সদস্য সংখ্যাও বাড়ছে দ্রুত গতিতে। অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী দেশগুলোর পাশাপাশি এমন কিছু দেশও যুক্ত হচ্ছে, যারা ভৌগোলিক কৌশলগত অবস্থান ও উন্নয়নমুখী সম্ভাবনার কারণে গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশ এখনো পূর্ণ সদস্য না হলেও তার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব, উদীয়মান অর্থনীতি এবং স্থিতিশীল সামাজিক কাঠামো তাকে ভবিষ্যতে ব্রিকসের আরও গভীর অংশীদারত্বের যোগ্য করে তুলছে।

বর্তমানে ব্রিকস কেবল অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক বলয়ের নাম নয়, এটি হয়ে উঠেছে একটি আদর্শ- পশ্চিমা আধিপত্যের বাইরে একটি স্বাধীন, বহুপাক্ষিক সহযোগিতানির্ভর বিশ্বব্যবস্থার স্বপ্ন। এই আদর্শে বাংলাদেশ যত বেশি যুক্ত হতে পারবে, তত বেশি লাভবান হবে অর্থনৈতিকভাবে, কূটনৈতিকভাবে এবং প্রযুক্তিগতভাবে। বিশেষ করে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক, ভারত ও ব্রাজিলের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য এবং মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার নতুন বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে ব্রিকস হতে পারে একটি কার্যকর মাধ্যম।

প্রসঙ্গত, ব্রিকসের শিল্পমন্ত্রীদের নবম বৈঠকে ২০২৫ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের উন্নয়নে একটি বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। রোবোটিক্স, ডিজিটালাইজেশন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং শিল্প ৪.০ প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মতো একটি তরুণ ও প্রযুক্তি-বান্ধব দেশের জন্য এটি এক সুবর্ণ সুযোগ। এখানকার স্টার্টআপ সংস্কৃতি, তরুণদের উদ্ভাবনী মনোভাব এবং কম খরচে উৎপাদনের সক্ষমতা আন্তর্জাতিক শিল্পখাতে বাংলাদেশকে নেতৃত্বে নিয়ে যেতে পারে। এনডিবির মাধ্যমে এই খাতে অর্থায়ন এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা পাওয়া গেলে আগামী এক দশকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি শিল্প কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।

বিশ্ব যখন একমেরু থেকে বহু মেরুতে এগোচ্ছে, তখন কেবল অর্থনীতিতে নয়, কূটনীতিতেও পরিবর্তন আসছে। বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতি একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং বহুমুখী বন্ধুত্বের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠছে। পশ্চিমা উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে, একইসঙ্গে ব্রিকসের মতো বলয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়া আমাদের জন্য বাস্তবসম্মত ও দূরদর্শী পদক্ষেপ হবে। রাশিয়া যখন ২০২৬ সালে এনডিবির বার্ষিক সম্মেলনের আয়োজন করবে, তখন বাংলাদেশ সেখানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কেবল একটি অর্থনৈতিক সম্পর্ক নয়, বরং একটি নতুন কূটনৈতিক পরিচয়ের সূচনা ঘটাতে পারবে।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের শক্তিশালী অবস্থান প্রতিষ্ঠার জন্য এখন সময় এসেছে আগেভাগেই প্রস্তুতি নেওয়ার। ব্রিকসের বিকল্প আর্থিক কাঠামো কেবল আমাদের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে না, বরং একটি স্বাধীন ও সমানাধিকারের বিশ্বব্যবস্থায় আমাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে। আর এ অংশগ্রহণের মূল চাবিকাঠি হবে কৌশলী কূটনীতি, বাস্তববাদী অর্থনৈতিক নীতি এবং ভবিষ্যতের জন্য দূরদর্শী প্রস্তুতি।

 

  • হোসাইন মোহাম্মদ সাগর

সাংবাদিক ও ব্রিকস+ ফেলো

ইমেইল: sendhusagar@gmail.com

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com